top of page
Search

'গুরুবাদের সত্য স্বরূপ'....(পরম্পরা বিরোধী মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সনাতন বৈদিক শাস্ত্র সিদ্ধান্ত)

.........................................................."গুরু".................................................................. গুরুবাদের সত্য স্বরূপ ও তার মাহাত‍্য বর্ণনার ক্ষুদ্র প্রয়াস। ------ (সায়ন দেবশর্মা)--------- ......................................................................................................................................

সনাতন-বৈদিক-আর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে; সৃষ্টির প্রারম্ভ বা কল্পারম্ভ থেকে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান স্বরূপ পরাপরাবিদ্যা তথা ব্রহ্মবিদ্যা সৃষ্টির অভিব্যঞ্জক সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীমন্নারায়ণ হতে ব্রহ্মা এবং ব্রহ্মা হতে ক্রমিক অভিব্যক্তির ধারায় যুগচক্রের পরম্পরায় শ্রীমন্ভগবানের নিত্য-নৈমিত্তিকাবতার ও তার অনুসারী বিভিন্ন আচার্যপদের দ্বারা ব্যবহারিক বিশ্বে প্রকাশিত হয়। যুগচক্রের প্রারম্ভে সচ্চিদানন্দস্বরূপ সর্বেশ্বরের জ্ঞানময় বিগ্রহ স্বয়ং দক্ষিণামূর্তি সদাশিব গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ন হন। পরাপরাবিদ্যা সহ কলাদি বিদ্যা তথা ব্রহ্মবিদ্যা ইত্যাদি সকল জ্ঞানবিজ্ঞান মহর্ষিগনের মাধ্যমে তিনি ইহজগতে প্রকাশিত করেন। তৎপরবর্তী আসন্ন সকল যুগেও যেন এই ঈশ্বরীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশুদ্ধ রূপে অতিবাহিত হতে পারে , তদুদ‍্যেশ‍্যে সৃষ্টি হয় গুরুকুল পরম্পরার। কালচক্রের গতিতে যুগের ঘাতে-অভিঘাতে যখনই শুদ্ধ সনাতন জ্ঞান-বিজ্ঞান আংশিক কলুষিত বা বিকৃত বা লুপ্ত হয়েছে, তখনই ভগবান স্বয়ং অবতারিত হয়ে তার শোধন তথা বিলুপ্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুনঃউৎভাসন করেন। এই ভাবেই এগিয়ে চলে ঈশ্বরীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান পরম্পরা ক্রমে, যা সকল যুগে শাশ্বত রূপে পরম্পরাকে আশ্রয় করে নিত্য-প্রকাশিত হয়। কাল চক্রে দ্বাপরযুগের অন্তিম চরণে আষাঢ় পূর্ণিমায় সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীমন্নারায়ণ তার অচিন্ত যোগমায়া বলে প্রকটিত হন নিমিত্ত‍্যাবতার ভগবান শ্রী কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস রূপে। যুগচক্রের প্রগতিতে মনুষ্যের মেধা ও প্রজ্ঞা শক্তির ক্রমিক অবক্ষয়;- যার ফলে ধর্মের ক্রমিক অবক্ষয় ও বিপরীতে অধর্মের ক্রমিক উন্নয়নের প্রকৃতিকে নিরুপন করে, মহর্ষি পরাশর ধর্ম ও তার আঁধার সনাতন জ্ঞানবিজ্ঞান রক্ষার্থে অন্য উপায় না দেখে রুদ্র-পুত্রী নামে প্রসিদ্ধ সর্বসিদ্ধিদাত্রী মা'নর্মদা নদী-তটে কঠোর তপস্যারত হলেন। তপস্যায় সারা দিয়ে সর্বেশ্বর ভগবান সয়ম তার পুত্র রূপে ধরাধামে অবতারিত হয়ে সকল বৈদিকজ্ঞানকে সময়ের প্রেক্ষিতে যথাযথ ভাবে উদ্ভাসিত ও রক্ষা করার দায়িত্ব নেন। দ্বীপের মাঝে ঋষি পরাশরের তপঃপ্রভাবে, মাতা সত্যবতীর মাধ্যমে প্রকটিত হন জগদগুরু যুগাচার্য ভগবান কৃষ্ণদৈপায়ন। দ্বীপে জন্ম তাই তাঁর নাম হয় দ্বৈপায়ন। তাঁর অসামান্য-অতুল্য প্রজ্ঞা-শক্তি মেধা, শক্তি-বলে যুগের প্রয়োজনে সনাতন ঈশ্বরীয় বৈদিক জ্ঞানের রক্ষার্থে সমগ্র বেদকে অনন্যতার নিরিখে চার ভাগে বিভাজন করেন, তাঁর আচার্য শিষ্যদের দ্বারা উদ্ভাসিত করেন অনন্য বৈদিক-ধারা সমূহের। অনবদ্য তথা অন্যন্য সুচারু কাব্যিকতায় সংকলন করেন তার সময়কালে ঘটে যাওয়া ধর্মাধর্মের সংঘাতের জাজ্বল্যমান প্রামানিক ইতিহাস স্বরূপ এক লক্ষ শ্লোক সম্বলিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ও ধর্মশাস্ত্র মহাভারত। মহাভারতের বর্ণনে তিনি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে দেন সমগ্র বৈদিক-ঈশ্বরীয় জ্ঞানকে, পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তাঁর রচিত মহাভারতে উদ্ভাসিত করেন স্বয়ং সচ্চিদানন্দ সর্বেশ্বর পদ্মনাভের নৈমিত্তিকাবতার শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের মুখনিঃসৃত সর্বপোনিষদ সার ভাগবদ্গীতাকে, যেই জ্ঞান করুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় তিনি অর্জুনকে উপলক্ষ করে জগৎহীতার্থে প্রকাশিত করেন। এই কারণে মহর্ষি কৃষ্ণদৈপায়ন বাদরায়ন ব্যাস কর্তৃক বিরোচিত মহাভারত সনাতন পরম্পরা কর্তৃক পঞ্চমবেদ রূপে মান্যতা প্রাপ্ত। শুধু এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সীমাবদ্ধ নয়;- বৈদিক জ্ঞানবিজ্ঞান তথা দর্শনকে চিরঅবিনাশী রাখতে, অস্তিকতার সত্য মার্গে পুরুষার্থ সিদ্ধি তথা লৌকিক-পারলৌকিক চরম উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে, তথা মোক্ষপদ প্রাপ্তি সুলভ করতে ভগবান কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসদেব অষ্টাদশ পুরান, অষ্টাদশ উপপুরাণ সহ ব্রহ্মসূত্র তথা সংহিতা, ভাষ্য গ্রন্থাদি রচনা করে কলির প্রাকট্যের পূর্বেই সনাতন-বৈদিক-আর্য ধর্মের মুলাধার রূপী বৈদিক জ্ঞানবিজ্ঞানকে সকল স্তরে রক্ষা ও পরম্পরাক্রমে প্রবাহের অনন্য ব্যবস্থা করে যান। মহর্ষি কৃষ্ণদৈপায়ন বদরায়ন ব্যাসের জীবদ্দশাতেই তাঁর সকল কৃতিত্ব প্রকটিত হয়। তাঁর শিষ্যগণ তাঁদের গুরু ভগবৎপাদ ব্যাসদেবের জ্ঞানপ্রসাদে পরিতৃপ্ত হয়ে তাঁর নিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানময় সারূপ‍্য অর্থাৎ ঈশ্বররূপ উপলব্ধি করেন। গুরুর মহিমা-গরিমাকে দৃষ্টান্ত রূপে সাক্ষ্য করতে যুগের নিমিত্তে তাঁরা এই আষাঢ় পূর্ণিমার দিনকে ঐতিহাসিক ব্যাসপূর্ণিমার আখ্যা দিলেন। এই দিনটিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানময় কল্পতরু সর্বেশ্বরের মানববিগ্রহ স্বরূপ গুরুর নিকট তাঁর প্রতি বর্ণনাতীত কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করতে শ্রীগুরুর পূজন মহোৎসব দিবস রূপে উদ্ভাসিত করেন।

এতদসত্ত্বেও যুগচক্রে আধুনিক সময়ে কলির তামসিক প্রভাবে ধর্মের নামে ধর্মবিচ্যুতি ঘটা ভ্রমমোহিত ইন্দ্রিয় পরায়ণ নামধারী সনাতনী প্রশ্ন তোলে গুরুর ভূমিকা নিয়ে। দেহাত্মবাদী পাশ্চাত্য চিন্তারীতির প্রভাবে তারা আপন পিতৃ-পুরুষ কর্তৃক পালিত স্বধর্ম, পরম্পরা সহ সনাতনের ভিত্তিস্বরূপ গুরুপদকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হননা বরং পরম্পরা সংস্কৃতির উচ্ছেদের দ্বারা প্রগতিশীলতার নামে বিধ্বংসী বিকার আনার চেষ্টায় নিত্য-রত আপন আপন ব্যক্তিস্বার্থে। তাদের আপাত প্রতীয়মান চাতুর্যতাই হলো সংস্কৃতি বিরুদ্ধ বিকট প্রশ্ন তুলে সাধারণ-মানুষের মনে আপন পরম্পরা-সংস্কৃতি নিয়ে সংশয় উৎপাদন করা। তাদের উত্তরে সনাতন পরম্পরায় স্বতঃসিদ্ধ স্মৃতি ও শ্রুতির প্রমান উপস্থাপন করব:-

এইক্ষণে প্রথমেই গুরুগীতার ২৬তম শ্লোকের উদ্ধৃতি দেব ;- "গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ। গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।"

গুরু ব্রহ্মা : ব্রহ্মা রূপী স্বয়ং গুরু এই বিজ্ঞানময় জগতের স্রষ্টা। গুরুকে সেই ব্রহ্মার সাথে তুলনা করা যায়। গুরু বিষ্ণু: বিষ্ণু রূপী স্বয়ং সেই গুরুকে'ই পালনকর্তা বিষ্ণুর সাথে তুলনা করা যায়। গুরু দেব মহেশ্বর : গুরু হচ্ছে মহেশ্বর ( শিব )। মহেশ্বর এই পশুপাশবদ্ধ জীবের সকল অজ্ঞান নাশ করেন। গুরু সাক্ষাত : যে গুরু সামনে বিরাজমান পরব্রহ্ম : তিনি'ই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মের জীবন্ত সাকার বিগ্রহ স্বরূপ তস্মই শ্রী গুরুবে নমঃ : সেই গুরুকে আমি সর্বান্তকরণে প্রণাম জানাই। "গু" : অর্থ "অন্ধকার"।। রু :অর্থ যিনি নাশ করেন।।― তাই বলা হলো― "অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।। ―অর্থাৎ;- যিনি অজ্ঞান-অন্ধকারাচ্ছন্ন শিষ্যের চক্ষু জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা দিয়ে উন্মোচন করে দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে সর্বান্তকরণে প্রণাম করি। ....তৎপরবর্তী শ্লোকেই বলা হলো― "মন্ত্রঃ সত্যং পূজা সত্যং সত্যং দেবো নিরঞ্জনঃ। গুরোর্বাক্যং সদা সত্যং সত্যমেব পরং পদম্।। –অর্থাৎ;- মন্ত্র সত্য, পূজা সত্য, দেব নিরঞ্জনও সত্য; শ্রীগুরুদেবের বাক্যও সর্ব্বদা সত্য বলেই জানিবে এবং সেই পরমপদও সত্য। ...পরবর্তী শ্লোক অদ্বৈত-সচ্চিদানন্দ স্বরূপ সর্বেশ্বরের সাথে মিলিত হওয়ার একমাত্র অবলম্বনরূপী গুরুকে নির্দেশিত করে বলছে;- "অখন্ড-মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্। তত্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।। অর্থাৎ:- যিনি অখন্ড-মন্ডলাকার স্বরূপে এই চরাচর বিশ্ব স্বরূপে পরিব্যাপ্ত হয়েছেন, তাঁর শ্রীপাদপদ্ম যিনি দর্শন করিয়ে দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি। এর পরের শ্লোক গুরুকে জাগতিক ভুমিতে অন্যতার শিখরে স্থান দিয়েছে, বলছে;- "পিতৃমাতৃ-সুহৃদ্বন্ধু-বিদ্যা-তীর্থানি দেবতা। ন তুল্যং গুরুণা শীঘ্রং স্পর্শয়েৎ পরমংপদম্"।। ―এই জগতে পিতামাতা, সুহৃৎ-বন্ধু, বিদ্যাবুদ্ধি, তীর্থসমূহ এবং দেবদেবী কেহই শ্রীগুরুদেবের সমতুল্য হতে পারে না; যেহেতু শ্রীগুরুদেবই একমাত্র সেই পরম ব্রহ্মপদ শীঘ্র লাভ করিয়ে দিতে পারেন।। তৎপরবর্তী শ্লোক সমূহ চরম বাস্তবিকতার সন্মুখে এনে বলছে;- "ধ্যানমূলং গুরোমূর্ত্তিঃ পূজামূলং গুরোঃ পদম্। মন্ত্রমূলং গুরোর্বাক্যং মোক্ষমূলং গুরোঃ কৃপা।। ব্রহ্মানন্দং পরম-সুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্ত্তিম্। দ্বন্দ্বাতীতং গগন-সদৃশং তত্ত্বমস্যাদি-লক্ষ্যম্।। একং নিত্যং বিমলমচলং সর্ব্বদা সাক্ষিভূতম্। ভাবাতীতং ত্রিগুণ-রহিতং সদ্গুরুং তং নমামি।। ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব। ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব। ত্বমেব বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব। ত্বমেব সর্ব্বং মম দেবদেব।।"― ―অর্থাৎ:- "যিনি ব্রহ্মানন্দ-স্বরূপ, পরম সুখদানকারী, নিলির্প্ত, জ্ঞান-মূর্ত্তি-স্বরূপ, যিনি সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বের অতীত, গগনসদৃশ উদার, ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের লক্ষ্য-স্বরূপ, যিনি এক, নিত্য, বিমল, অচল, সর্ব্বদা সমস্ত কিছুর সাক্ষীস্বরূপ, ভাবাতীত ও ত্রিগুণাতীত, সেই পরব্রহ্মের জীবন্তবিগ্রহ রূপী শ্রীশ্রীসদ্গুরুকে ঐকান্তিক ভক্তিসম্বলিত হয়ে প্রণাম করি। হে গুরুদেব, তুমিই আমার মাতা, তুমিই আমার পিতা, তুমিই বন্ধু, তুমিই সখা। তুমিই আমার বিদ্যাবুদ্ধি, তুমিই আমার ধনৈশ্বর্য্য সবই; শুধু তাই নয়, হে আমার প্রাণদেবতা, তুমিই আমার জীবনের যথাসর্বস্ব।"

এইভাবেই সনাতন পরম্পরায় শ্রীশ্রীসদ্গুরুর শ্রীচরণে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণই বিশুদ্ধ জ্ঞানবিজ্ঞান প্রাপ্তি তথা আত্মজ্ঞান প্রাপ্তির একমাত্র উপায় হিসেবে মান্যতা প্রাপ্ত এবং এই চিরায়িত মান্যতার দরুন সনাতন ভারতের স্বর্ণ যুগে, যখন গুরুপরম্পরা, গুরুপদ ও তার ভূমিকা এই ভাবে রক্ষিত ও মান্য হতো; একমাত্র সেই যুগেই সনাতনের অনন্য, নির্বিকল্প শ্রেষ্ঠত্বম কীর্তি সমূহের আত্ম-প্রকাশ ঘটেছে। আজকের বিশ্বে যা শুধু ঐতিহাসিক বিস্ময় রূপেই রয়েছে কিন্তু জগৎহীতার্থে অনন্য কীর্তির পরম্পরা সনাতনবৈদিক পরম্পরার সাথে প্রায়-বিলোপের হাত ধরে বিলুপ্তির সন্নিকটে উপস্থিত। তবুও এখনি হয়ত কলির ভস্মাসুর রূপী পরম্পরা-বিদ্বেষীগণ পুনরায় শৃগালের ন্যায় চিৎকার করে সংশয়ের উদ্রেগ করবে , "শ্রুতি'ই মান্য স্মৃতি বা পুরানাদি অসঙ্গতি পূর্ণ তাই এসকল কথা মানিনা!" তাই প্রতিজ্ঞানুসারে শ্রুতি দ্বারাই সচ্চিদানন্দ জীবন্ত বিগ্রহরূপী গুরুর স্বরূপ দেখাব;-

★ যথাগুরুস্তথৈবেশো যথৈবেশস্তথা গুরুঃ পূজনীয়ো মহাভক্ত্যা ন ভেদো বিদ্যতেহনয়ো।। (যোগশিখোপনিষদ-৫/৫৮) অর্থাৎ : যিনি গুরু তিনি ঈশ্বর, গুরু এবং ঈশ্বরে মধ্যে কোন ভেদ নেই, কোন ভেদ গুরু এবং ঈশ্বের মধ্যে কল্পনা করা যায় না।

★ গুরুরেব হরি : সক্ষন্নান্য ইত্যব্রবীচ্ছুতিঃ।। ৩১।। (ব্রহ্মবিদ্যোপনিষদ -৩১ নং মন্ত্র) অর্থাৎ : গুরুই সাক্ষাৎ হরি, অন্য কেউ নয় শ্রুতি এই বলেছেন।

★ গুরুরেব পরংব্রহ্ম গুরুরেব পরা গতিঃ। (অদ্বয়তারকোপনিষদ - ১৭ নং মন্ত্র) অর্থাৎ : গুরুই পরম ব্রহ্ম, গুরুই পরম গতি।

★শৌনকো হ বৈ মহাশালোহঙ্গরসং বিধিবদুপসন্নঃপপ্রচ্ছ----- কসিন্নু্ ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি।। (মুন্ডক উপনিষদ -- ১/১/৩) অর্থাৎ : গৃহস্থ - প্রধান শৌনক যথাবিধি অঙ্গিরা ঋষির নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, 'ভগবন্' কোন বিষয় বা বস্তুটি জানিলে এই সমস্ত (জগৎ) বিশেষরুপে জানা যায়। * এইখানে স্পষ্টতর ভাবে বুঝা যাচ্ছে, 'শৌনক' তার গুরুদেব 'অঙ্গিরা'-কে ভগবান নামে আহবান্ করছেন, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য।

★এছাড়াও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ উদ্ঘোষ করছে—

”ইষ্টদেবতার প্রতি যেরূপ ভক্তি, ঠিক সেইরূপ ভক্তি যদি গুরুদেবে থাকে তাহলে সাধনজীবনের সমস্তপথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।”(৬।২৩)

★গুরুর শাস্ত্রীয় অপর নাম আচার্য। কঠ উপনিষদে আছে— আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে যিনি উপদেশ দেন তিনি আচার্য। উত্তম আচার্যের কাছে যে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করেছে তিনি পবিত্র। ( কঠোপনিষদ, ১।২।৭ )

বৈদিকযুগে গুরুর কাছে ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য শিষ্যদের গুরুগৃহে বসবাস করতে হত।

------------------------ এখানেই শেষ নয় মহর্ষি গৌতম তাঁর সংহিতাশাস্ত্রও শ্রীগুরুর মহিমা প্রকাশ করেছেন;- ★ স্কত্রে তৎ সমাচরেদ্ যোগক্ষমাথমীশ্বরমধিগচ্ছেন্নান্ন -মন্যত্র দেবগুরুধার্ম্মিকেভ্য : প্রভূতৈধোদকযবসকূশ। (গৌতম সংহিতা, ৯ম অধ্যায়) অর্থাৎ : যোগক্ষমলাভার্থ ঈশ্বরের নিকট গমন করিবে, অম্বত্র গমন করিবে না। দেবতা,গুরু এবং ধার্ম্মিক ইহারাই ঈশ্বর।

এছাড়াও পরমহংস সংহিতা অর্থাৎ শ্রীমদ্ভাগবতম্-এর ১১তম স্কন্দে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন;- আচার্যং মাং বিজানীয়ান্নাবমন্যেত কহিচৎ ন মর্ত্যবুদ্ধ্যাসুয়েত সর্বদেবময়ো গুরু:।

অর্থাৎ : গুরুকে আমার স্বরূপ বলিয়া জানিবে, সমস্ত দেব-দেবতার সম্মিলিত রুপ হচ্ছে গুরু।

আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন : ★ নাহমিজ্যাপ্রজাতিভ্যাং তপসোপশমেন চ তুষেয়ং সর্বভূতামা গুরু শুশ্রুষয়া যথা। ( ভাগবত -১০/৮০/৩৪) অর্থাৎ : আমি গুরু ভক্তিতে যতটা তুষ্ট হয়, বেদপাঠ দ্বারা তপস্যা দ্বারা ততটা তুষ্ট হয় না। * ভগবান গুরুকে নিজের স্বরুপ বলে প্রকাশ করছেন। অতএব, অব্যশই শ্রীগুরুদেবকে ভগবান জ্ঞানে পূজ করবার আদেশ সয়ম নারায়ণ শ্রীবিষ্ণুর লীলাপুরুষোত্তমাবতার যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন।

★(নারদপঞ্চরাত্র :২/৮/২০) ”তদগুরোঃ প্রতিবিম্বশ্চ সর্বত্র নররূপকঃ। গুরুরূপী স্বয়ং কৃষ্ণঃ শিষ্যাণাং হিতকাম্যয়া।।”

— সেই গুরুর নররূপ প্রতিবিম্ব সর্বত্রই পতিত হচ্ছে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ শিষ্যগণের সহিত বাসনায় গুরুরূপ করিয়াছেন। -----------------এছাড়াও অদ্বৈতবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জগৎগুরু শঙ্করাচার্য তাঁর বিবেকচূড়ামণিতে বলেছেন—

”হে গুরু, আমি জন্ম-মরণ তরঙ্গ-সঙ্কুল সমুদ্রে পড়েছি। এই কষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন।” ( বিবেকচূড়ামণি, ১৩৯ )

যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন—

আমাদের ভিতরে যে জ্ঞান আছে, তাহার উন্মেষের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তিগণের নিকট সর্বদা আমাদের থাকা প্রয়োজন। সুতরাং গুরুগণের প্রয়োজন। তাহাদের সহায়তা ব্যতীত কোন জ্ঞানই সম্ভব নয়।

ভূতেধরা মানুষ যেমন জানেনা যে তাকে ভূতে ধরেছে, তেমনিই মায়াচ্ছন্ন জীব জানেনা যে, সে মায়ামুগ্ধ। এমন মায়ামুগ্ধ জীবকে জাগাতে হলে অন্য কোন শক্তি বা ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি মায়াতীত। এই মায়ারূপ জগত থেকে পরিত্রাণ পেতেই গুরুর দরকার।

★চৈতন্যচরিতামৃতে আছে— ”গুরুরূপে কৃষ্ণ কৃপা করেন ভক্তগণে।”

★অদ্বৈতবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আচার্য শিবাবতার ভগবৎপাদ আদিশঙ্কর নিজেই বলেছেন—

”অদ্বৈতং ত্রিষু লোকেষু নাদ্বৈতং গুরুণা সহ।” অর্থাৎ— ত্রিভুবনে ( সর্বত্র) অদ্বৈতবুদ্ধি এবং অদ্বৈতভাব রাখবে কিন্তু গুরুর সঙ্গে কদাপি নয়।

শ্রীভগবান জীবের অন্তর্যামীরূপে এবং শাস্ত্ররূপে নিত্য অবস্থিত। ঠিক গুরুরূপেও তিনি নিত্য ও শাশ্বত। এই নিত্য গুরুর অপর নাম সমষ্টিগুরু বা জগদগুরু। এই সমষ্টিগুরুর অসংখ্য প্রকাশ ব্যষ্টিগুরুরূপে। অর্থাৎ ব্যষ্টির গুরুর যোগফল হল সমষ্টিগুরু বা জগৎগুরু বা স্বয়ং ভগবান। যিনি জগৎগুরু তিনি লৌকিকগুরু বা ব্যষ্টি গুরুদেরও গুরু ।

এই কারণেই শ্রীমন্ভগবানের নিমিত্যাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন— ”সচ্চিদানন্দই গুরু। সচ্চিদানন্দই গুরুরূপে আসেন।”

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান ব্যাসদেব, শুকদেব, শিবাবতার জগদগুরু ভগবান আদি শঙ্করাচার্য ও তার পরম্পরার আচার্যগনের জীবনে আমরা সেটিই লক্ষ্য করি। এই কারণেই তাঁরা জগৎগুরু। গুরুদেরও গুরু তাঁরা।

★ গুরুপদের যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে #পুরীপীঠাধীশ্বর_জগদগুরু_শঙ্করাচার্য_স্বামী_নিশ্চলানন্দ_স্বরস্বতীজীর অভিমত :― গুরু হবেন শাস্ত্রজ্ঞ এবং ব্রহ্মবিদ্যায় পারঙ্গত। তিনি শাস্ত্রের মর্ম জানবেন, নিজ জীবনে যথাযথভাবে পালন করবেন। গুরুর চরিত্র হবে নিষ্পাপ। হৃদয় ও মনে পবিত্র থাকবেন। গুরু যেন কখনই অর্থ, মান, যশ বা কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্য লালায়িত না হন। সর্বজীবের কল্যাণে নিজেকে এবং শিষ্যদের অনুপ্রাণিত করবেন এবং দ্বেষবুদ্ধি ত্যাগ করবেন। সর্বোপরি গুরু হবেন নিরহংকারী।

★ শিষ্যের যোগ্যতা :- প্রকৃত শিষ্য হবেন পবিত্র, জ্ঞানপিপাসু ও অধ্যবসায়ী। শুধু ধর্মকথা শুনবেই না, নিজ জীবনে পালন করবে। যতদিন প্রাণে ব্যাকুলতা না জাগে ততদিন সে সংগ্রাম, সাধনা করেই চলবে। গুরুর শক্তি গ্রহণ করার শক্তি শিষ্যের মধ্যে থাকতে হবে। গুরুর আজ্ঞা পালনে সর্বদা শ্রদ্ধাবান হতে হবে এবং ইন্দ্রিয় সংযত করা শিষ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

★ সনাতন-বৈদিক-আর্য ধর্মে মূল গুরুপরম্পরার ভাবধারা:

১। নারায়ণ

২। ব্রহ্মা ( চতুর্মুখে বেদ কীর্তন করেছেন)

৩। সর্বেশ্বর সচ্চিদানন্দের জ্ঞানমূর্তী স্বরূপ দক্ষিণামূর্তি আদি যোগী সদাশিব।(সত্যযুগের প্রারম্ভে)

৪। সনক, সনন্দন, সনৎকুমার, সনাতন।

৫। অত্রি, মরীচি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, ক্রতু, বশিষ্ঠ এবং পুলহ।

৬। ব্যাসদেব

৭। শুকদেব ( শুকদেব আজন্ম ব্রহ্মচারী ছিলেন বলে শিষ্য পরম্পরাক্রমে এ জ্ঞান পৌছায় গৌড়পাদের নিকট)

৮। গৌড়পাদাচার্য

৯। গোবিন্দপাদাচার্য

১০। আচার্য ভগবৎপাদ 'আদি শঙ্কর'

১১। সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, হস্তামলক, তোটক। মঠাম্নয়ের দশনামি ভুক্ত আচার্যদের হাত ধরে উত্তরকালীন স্বীকৃত স্মার্ত-বৈষ্ণব ও তান্ত্রিক আচার্যপদ এবং সম্প্রদায়।

( নারায়ণ থেকে ক্রমানুসারে নিচের দিকে হিসেব করতে হবে )

√ আচার্য শঙ্কর সনাতন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে দশটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেন। এরা দশনামী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। তিনি ভারতবর্ষের চার প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দশনামী সম্প্রদায়কে এই চার মঠের অধীনস্ত করেন।

√ চৈতন্য মহাপ্রভুর মত ও পথের মূল উৎস আচার্য আদি শঙ্করের দ্বারা উদ্ভাসিত দশনামি দন্ডী সন্যাসী আচার্য শ্রীমাধবেন্দ্র পুরী। যদিও তিনি আর এক দশনামি দন্ডী স্বামী কেশবভারতীর নিকট সন্ন্যাস নিয়েছেন। কিন্তু মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরীই প্রথম তাঁর আধ্যাত্মিক প্রতিভা জাগ্রত করেন।

( চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্যভাগবত দ্রষ্টব্য )

√ মহাপ্রভু ভারতী নামা সন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

√ অপরদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব পুরী সম্প্রদায়ের বিদগ্ধ ব্রহ্মজ্ঞ সন্ন্যাসী তোতাপুরীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন এবং অদ্বৈতপথে নির্বিকল্প সমাধী লাভ করেছেন।

অতএব, সৃষ্টির প্রারম্ভে শ্রীমন্নারায়ণ থেকে ব্যাস থেকে শুকদেব ক্রমে গৌরপাদাচার্য, গোবিন্দপাদাচার্য, আদিশঙ্করাচার্য হতে বর্তমান মান্য সনাতন-বৈদিক-আর্য পরম্পরাভুক্ত আচার্যপদ পর্যন্ত পরম্পরাক্রমে যে শক্তি প্রবাহিত হয়েছে তা'ই একমাত্র সত্য-শাশ্বতঃ-সনাতন-বিজ্ঞান স্বরূপ।

সুতরাং শঙ্করাচার্য কতৃক প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ভারতী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ভগবান চৈতন্য মহাপ্রভু ও ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

★ এমন কি সর্বেশ্বরের নৈমিত্তিকাবতারের ও ইহজগতে গুরুকরণ হয়― ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের গুরু ছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ, ঋষি বিশ্বামিত্র। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গুরু ছিলেন সান্দীপন মুনি।

★ গুরুনিন্দা সনাতন পরম্পরায় মহাপাপ বলেই বিবেচিত: ভগবান শঙ্কর মাতা পার্বতীকে বলেছেন—

এবং শ্রুত্বা মহাদেবি গুরুনিন্দাং করোতি যঃ স যাতি নরকং ঘোরং যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ।। ( গুরুগীতা, ৫৯ )

সরলার্থ : হে মহাদেবি, গুরুতত্ত্ব এইভাবে শ্রবণ করিয়াও যে ব্যক্তি গুরুনিন্দা করে, যতদিন চন্দ্রসূর্য বিরাজ করিবে, ততদিন তাহাকে ঘোর নরকে বাস করিতে হইবে।

★ প্রার্থনা: মন্নাথঃ শ্রীজগন্নাথো মদগুরুঃ শ্রীজগদগুরুঃ। মমাত্মা সর্বভূতাত্মা তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।। ( গুরুগীতা, ৩৭ )

সরলার্থ : যিনি আমার নাথ, তিনিই জগতের নাথ। যিনি আমার গুরু তিনিই জগতের গুরু। আমার আত্মাই সমস্ত জীবের আত্মা- এই জ্ঞান যাঁহার কৃপায় হয় সেই গুরুদেবকে বারবার প্রণাম করি।

আসুন ঐক্যবদ্ধ হই মূল সনাতন পরম্পরার ছাত্রতলে। পরম্পরার যথোচিৎ সম্মান ও পালনের মাধ্যমে। সমষ্টি তথা বেষ্টির সামগ্রিক উৎকর্ষে মূল সনাতন-বৈদিক-আর্য ধারার পরম্পরা প্রাপ্ত মান্য আচার্য দ্বারা বিধিমুখ বৈদিক-ঈশ্বরীয়-বিজ্ঞান তথা কলা চর্চায় ব্রতী হই। স্বাধ‍্যায়ের নামে সকল পরম্পরারোহিত প্রলয়ঙ্করী নিষেধমুখ দ্বারা প্রাপ্ত শাস্ত্রচর্চা বর্জন করে আত্মোন্নতির দ্বারা বিশ্বেরকল্যাণের মার্গ প্রসস্থ করি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ:-

★নিখিলবঙ্গ ধর্মচক্র প্রচার পরিষদের সকল সদস্যবৃন্দ (অখন্ডভারত,―পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ)

★©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©★ ―◆অনুলিপি ক্ষেত্রে ক্রেডিট ও পোস্টে ব্যবহৃত লোগো সমেত চিত্রের ব্যবহার বাঞ্চনীয়◆―





 
 
 

コメント


Post: Blog2 Post

Subscribe Form

Thanks for submitting!

  • Facebook
  • Twitter
  • LinkedIn
  • Facebook

©2020 by Vedicarya. Proudly created with Wix.com

bottom of page